ষষ্ঠ অধ্যায়-ধ্যানযোগ-(Bangla Gita)
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।
স্বাগতম! আজ আমরা প্রবেশ করব শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে — ধ্যানযোগ।
এই অধ্যায় আমাদের শেখায়, কিভাবে একাগ্রচিত্তে ধ্যান করে আত্মসাক্ষাৎ লাভ করা যায়।
জীবনযুদ্ধে যখন মন ছুটে বেড়ায় বহির্বিশ্বে, তখন ধ্যানই হয়ে ওঠে মোক্ষের দ্বার।
আসুন, আজকের এই মহৎ শাস্ত্রের আলোকে আমরা সন্ধান করি — সত্যজ্ঞান, আত্মসংযম ও ভগবানের অভ্যন্তরীন উপলব্ধির পথ।
শুরু করছি শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত মহাবাণী — বাংলায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যার সঙ্গে।"**
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশূন্য তিনি সন্যাসী বা যোগী নন। যিনি কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই যথার্থ সন্নাসী বা যোগী।
অনুবাদঃ হে পান্ডব! যাকে সন্ন্যাস বলা যায়, তাকেই যোগ বলা যায়, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না।
অনুবাদঃ অষ্টাঙ্গযোগ অনুষ্ঠানে যারা নবীন, তাদের পক্ষে কর্ম অনুষ্ঠান করাই উৎকৃষ্ট সাধন, আর যাঁরা ইতিমধ্যেই যোগারূঢ় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে সমস্ত কর্ম থেকে নিবৃত্তিই উৎকৃষ্ট সাধন।
অনুবাদঃ যখন যোগী জড় সুখভোগের সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে এবং সকাম কর্মের প্রতি আসক্তি রহিত হন, তথন তাঁকেই যোগারূঢ় বলা হয়।
অনুবাদঃ মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে।
অনুবাদঃ যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু।
অনুবাদঃ জিতেন্দ্রিয় ও প্রশান্তচিত্ত ব্যক্তি পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাঁর কাছে শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ এবং সম্মান ও অপমান সবই সমান।
অনুবাদঃ যে যোগী শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্ব অনুভূতিতে পরিতৃপ্ত, যিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি মৃৎখন্ড,প্রস্তর ও সুবর্ণে সমদর্শী, তিনি যোগারূঢ় বলে কথিত হন।
অনুবাদঃ যিনি সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, মৎসর, বন্ধু, ধার্মিক ও পাপাচারী-সকলের প্রতি সমবুদ্ধি, তিনিই শ্রেষ্ঠতা লাভ করেন।
অনুবাদঃ যোগারূঢ় ব্যক্তি সর্বদা পরব্রহ্মে সম্পর্কযুক্ত হয়ে তাঁর দেহ, মন ও নিজেকে নিয়োজিত করবেন, তিনি একাকী নির্জন স্থানে বসবাস করবেন এবং সর্বদা সতর্কভাবে তাঁর মনকে বশীভূত করবেন। তিনি বাসনামুক্ত ও পরিগ্রহ রহিত হবেন।
অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের নিয়ম এই যে, কুশাসনের উপর মৃগচর্মের আসন, তার উপরে বস্ত্রাসন রেখে অত্যন্ত উচ্চ বা অত্যন্ত নীচ না করে, সেই আসন পবিত্র স্থানে স্থাপন করে তাতে আসীন হবেন। সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত, ইন্দ্রিয় ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাস করবেন।
অনুবাদঃ শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সমানভাবে রেখে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে, নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শূন্য ও ব্রহ্মচর্য-ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে, আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন।
অনুবাদঃ এভাবেই দেহ, মন ও কার্যকলাপ সংযত করার অভ্যাসের ফলে যোগীর জড় বন্ধন মুক্ত হয় এবং তিনি তখন আমার ধাম প্রাপ্ত হন।
অনুবাদঃ অধিক ভোজনকারী, নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় ও নিদ্রাশূন্য ব্যক্তির যোগী হওয়া সম্ভব নয়।
অনুবাদঃ যিনি পরিমিত আহার ও বিহার করেন, পরিমিত প্রয়াস করেন, যাঁর নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়-জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।
অনুবাদঃ যোগী যখন অনুশীলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবং সমস্ত জড় কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করেন, তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়।
অনুবাদঃ বায়ুশূন্য স্থানে দীপশিখা যেমন কম্পিত হয় না, চিত্তবৃত্তির নিরোধ অভ্যাসকারী যোগীর চিত্তও তেমনইভাবে অবিচলিত থাকে।
অনুবাদঃ যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণরূপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত হয়, সেই অবস্থাকে যোগসমাধিবলা হয়। এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন। সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুথ অনুভূত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না। জড় জগতের সংযোগ-জনিত সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।
অনুবাদঃ অবিচলিত অধ্যবসায় ও বিশ্বাস সহকারে এই যোগ অনুশীলন করা উচিত। সংকল্পজাত সমস্ত কামনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সব দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করা কর্তব্য।
অনুবাদঃ ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে আত্মাতে স্থির করে এবং অন্য কোন কিছুই চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়।
অনুবাদঃ চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে মনকে আত্মার বশে আনতে হবে।
অনুবাদঃ ব্রহ্মভাব-সম্পন্ন, প্রশান্ত চিত্ত, রজোগুণ প্রশমিত ও নিষ্পাপ হয়ে যাঁর মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে, তিনিই পরম সুখ প্রাপ্ত হন।
অনুবাদঃ এভাবেই আত্মসংযমী যোগী জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম-সংস্পর্শরূপ পরম সুখ আস্বাধন করেন।
অনুবাদঃ প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন। যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকে দর্শন করেন।
অনুবাদঃ যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না।
অনুবাদঃ যে যোগী সর্বভূতে স্থিত পরমাত্মা রূপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন, তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতে অবস্থান করেন।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন- হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।
অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে মহাবাহো! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যর দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।
অনুবাদঃ অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই আমার অভিমত।
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে কৃষ্ণ! যিনি প্রথমে শ্রদ্ধা সহকারে যোগে যুক্ত থেকে পরে চিত্তচাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়ে যোগে সিদ্ধিলাভ করতে না পারেন, তবে সেই ব্যর্থ যোগীর কি গতি লাভ হয়?
অনুবাদঃ হে মহাবাহো কৃষ্ণ! কর্ম ও যোগ হতে ভ্রষ্ট ব্যক্তি ব্রহ্ম লাভের পথ থেকে বিমূঢ় হয়ে যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে, সে কি ছিন্ন মেঘের মতো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে?
অনুবাদঃ হে কৃষ্ণ! তুমিই কেবল আমার এই সংশয় দূর করতে সমর্থ। কারণ, তুমি ছাড়া আর কেউই আমার এই সংশয় দূর করতে পারবে না।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ! শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদের ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি হয় না। হে বৎস! তার কারণ, কল্যানকারীর কখনও অধোগতি হয় না।
অনুবাদঃ যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যবানদের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমূহে বহুকাল বাস করে সদাচারী ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা শ্রীমান ধনী বণিকদের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।
অনুবাদঃ অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান যোগিগণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রকার জন্ম এই জগতে অবশ্যই অত্যন্ত দুর্লভ।
অনুবাদঃ হে কুরুনন্দন! সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি পুনরায় তাঁর পূর্ব জন্মকৃত পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।
অনুবাদঃ তিনি পূর্ব জন্মের অভ্যাস বসে যেন অবশ হয়ে যোগ-সাধনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রকার যোগশাস্ত্রের জিজ্ঞাসু পুরুষ বেদোক্ত সকাম কর্মমার্গকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ সকাম কর্মমার্গে যে ফল নির্দিষ্ট আছে, তার থেকে উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন।
অনুবাদঃ যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন।
অনুবাদঃ যোগী তপস্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মীদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। অতএব, হে অর্জুন! সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও।
অনুবাদঃ যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদগত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।
**"আজকের এই ‘ধ্যানযোগ’ অধ্যায়ের মাধ্যমে আমরা বুঝলাম — আসল সাধনা বাহ্যিক নয়, অন্তরায়ন।
ধ্যান, সংযম আর ঈশ্বরপ্রেমের মধ্য দিয়েই আত্মার প্রকৃত মুক্তি।
আপনি যদি এই জ্ঞানকে মূল্যবান মনে করেন, অনুগ্রহ করে ভিডিওটি শেয়ার করুন ও লাইক দিন।
আমাদের চ্যানেল ‘Bangla Gita’ সাবস্ক্রাইব করুন এবং 🔔 বেল আইকন চাপুন, যাতে পরবর্তী অধ্যায় ‘জ্ঞান-বিদ্যা যোগ’ আপনাকে সময়মতো পৌঁছায়।
শ্রীকৃষ্ণের কৃপা সবার ওপর বর্ষিত হোক।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥**
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন